বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠ

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ে অনেকগুলো নতুন বই এসেছে বাতিঘরে। বইগুলোতে রয়েছে সময়কে ইতিহাসের প্রয়োজনে মলাটবন্দী করার আয়োজন। আবার কোনো কোনো বইয়ে ইতিহাসকে নতুন আলোয় তুলে আনার প্রয়াস রয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের চিন্তামূলক লেখার সংকলন যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থও।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু পুরনো বই সম্প্রতি (আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে) পুনঃমুদ্রণ হয়েছে। বইগুলো বেশ পুরনো। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বইগুলো বাজার কাটতি। ড. ইউনূস সম্পর্কে আগ্রহীরা বইগুলো কিনছেন।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে দেশে। শাসনব্যবস্থার বদল হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য জুলাই-আগস্ট ছিল একটি ঝোড়ো সময়। একদিকে রাজপথ ছিল জনতার দখলে, আরেকদিকে চলছে আশঙ্কা। কমবেশি সবাই রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিতর্কে জড়িয়েছেন। এখন রাজনৈতিক বিতর্ক আর আড্ডার খোরাক জোগায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল প্রসারের কারণে বই পড়ার অভ্যাস কমেছে বলা হয়। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা।

শুধু ড. ইউনূস নন, আগস্টজুড়ে বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আলী রীয়াজ, আলতাফ পারভেজ, শাহাদুজ্জামান, ফরহাদ মজহার, সুহান রিজওয়ান, পিনাকী ভট্টাচার্য, এম সাখাওয়াত হোসেন, আনু মুহাম্মদ, আসিফ নজরুল ও মহিউদ্দিন আহমেদের মতো সক্রিয় লেখক গবেষকদের বই। বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সময়ও বটে।

দেশের মননশীল ও গবেষণাধর্মী পুস্তক মুদ্রণশিল্পের অন্যতম সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স লিমিটেডের (ইউপিএল)। ইউপিএলের কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিন সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছেন- বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এমন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন এবং এজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকা দরকার। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আর না থাকার পেছনে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সরকারি অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যাকাডেমিক গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নিতে হবে।

৩১শে আগস্ট তিনি দ্য ডেইলি স্টারে ইট ইজ টাইম টু রিফর্ম দ্য পাবলিশিং সেক্টর শিরোনামে এক কলামে তিনি লিখেন- অতীতের শাসনামলে এমন বইগুলোয় বিনিয়োগ ছিল, যেগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী পরিবেশন করেছিল, একটি নির্দিষ্ট আখ্যান ও বয়ান হয়ে উঠেছিল কণ্ঠস্বর। প্রকাশনাগুলোও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়েছিল। বেশিরভাগ সরকারি প্রকল্পের বই অধিগ্রহণ প্রাথমিকভাবে কিছু লেখক, আমলা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পক্ষে করা হয়েছিল যারা রাতারাতি সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হয়ে ওঠেন। কারণ, তাদের বইগুলো বড় সরকারি কেনাকাটার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। (অনুবাদ- লেখক)।

ইউপিএল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ইতিহাসধর্মী গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা। গুণগত বিচারে এ প্রকাশনীর বইগুলো সিরিয়াস টেক্সট হিসেবে নেওয়া যায়।

মাহরুখ লিখেছেন- 'আমরা আশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকৃত রাষ্ট্রের ভিত্তি পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যা তার রাষ্ট্র-সংস্কার এজেন্ডার কেন্দ্রে জ্ঞান উৎপাদন ও প্রসারে শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করবে। এটি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হবে প্রকাশনা খাতকে গ্রাউন্ড আপ থেকে সংস্কার করা। নিশ্চিন্ত থাকুন, তারা এই অত্যাবশ্যকীয় এবং অতি-প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে অনুঘটক করার জন্য এ বাণিজ্যে সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতিভাবান ব্যক্তিদের তরুণ এবং দেশপ্রেমিক শক্তির উপর নির্ভর করতে পারে। (অনুবাদ- লেখক)।

মাহরুখের কথাগুলো আমলে নেওয়ার মতো। রাজনৈতিক ইতিহাসকে দলীয় বলয়ে বন্দী না করে তিনি স্বাধীন প্রকাশনা ও গবেষণা শিল্পে মন দিতে বলেছেন সরকারকে।
 
বই মানসিক চাপ কমানোর দারুণ একটি উপায়। আমরা একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছি। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস যাদের, তাদের এখন সময় কাটছে বইয়ের সাথেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে বইয়ের বিক্রি ও প্রচারণা। বিভিন্ন প্রকাশনী ফেসবুক পেইজে রাজনৈতিক ইতিহাস ও সমসাময়িক পরিস্থিতির ওপর কিছু বইকে প্রামোশন করছেন। প্রতিদিনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা মানুষের জন্য বই হতে পারে মানসিক চাপমুক্তির একটি পথ। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সঙ্গে মানুষে আন্তঃসংযোগ বেড়েছে।
 
বইয়ের দোকান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলছে, রাজনৈতিক তুফানের মধ্যেই সম্প্রতি বেড়েছে বই পড়ার আগ্রহ। দেশের রাজনীতিতে পালাবদলের ফলে অজানা ইতিহাস জানতে চলছে জমজমাট বই পড়া ও পুরাতন নতুন বইয়ের ব্যবসা। নতুন ও পুরাতন প্রজন্ম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা বয়ানের খোঁজে সন্ধান করছে নানা ধরনের বই। চট্টগ্রামের মননশীল পুস্তক বিপণিকেন্দ্র বাতিঘর। মধ্য আগস্টের পরপরই এখানে বেড়েছে রাজনৈতিক ইতিহাসধর্মী বইয়ের বিকিকিনি।

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ে অনেকগুলো নতুন বই এসেছে বাতিঘরে। বইগুলোতে রয়েছে সময়কে ইতিহাসের প্রয়োজনে মলাটবন্দী করার আয়োজন। আবার কোনো কোনো বইয়ে ইতিহাসকে নতুন আলোয় তুলে আনার প্রয়াস রয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের চিন্তামূলক লেখার সংকলন যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থও।
 
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাতিঘরের ক্যাশ কাউন্টার থেকে নিয়মিত বই বিক্রির পাশাপাশি ফোনে ও অনলাইনে বই অর্ডার বেড়েছে, যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক ইতিহাসের। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। তখন অনেকেরই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস ছিল। অথচ, বর্তমানে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, বই পড়ার বিষয়টি খুব কমই চিন্তা করি। তাই সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে বোঝার জন্য রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু বইয়ের প্রতি জোর দিতে চাই। এই সময়ে এসে রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ ও চর্চার কিছু জরুরি বই আমাদের পড়া দরকার।
 
আন্দোলন সংগ্রাম ও সহিংসতায় ভরা এই দেশের অতীত জানতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে এমন একটি বইয়ে যা সংঘাতের রাজনৈতিক উৎসকে তুলে ধরে। 'সংঘাতময় বাংলাদেশ অতীত থেকে বর্তমান' (মো. বদরুল আলম খান) তেমনিই একটি বই। যদিও বর্তমানে বইটির মুদ্রিত কপি নেই।
 
এদিকে মুহাম্মদ ইউনূসের চিন্তা ও লেখা সম্পর্কে জানতে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে তার কিছু বইয়ে। সামাজিক ব্যবসা, পথের বাধা সরিয়ে নিন, মানুষকে এগুতে দিন বইগুলো তার চিন্তা ও তৎপরতাকে তুলে ধরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এগুলো আগস্ট (২০২৪) মাসে পুনঃমুদ্রিত হয়েছে।
 
অধ্যাপক আলী রীয়াজের তিনটি বই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো- ইতিহাসের দোলাচল: বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন।
 
আলী রীয়াজ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দোলাচল: বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বইতে লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির গত ৫০ বছরের পথপরিক্রমা একরৈখিক নয়, ঘটনাবহুল ও বন্ধুর; আছে উত্থান ও পতন। এই ঘটনাপ্রবাহের ভেতরে যেসব প্রবণতা এবং নাগরিকদের যে আকাঙ্ক্ষাগুলো অপরিবর্তিত থেকে গেছে সেসব চিহ্নিত করেছেন তিনি। ইতিহাস আলোচনার প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।
 
আলী রীয়াজের আরেকটি বই এই সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক সেটি হলো- লুণ্ঠিত ভবিষ্যৎ। যেখানে সম্পাদক আলী রীয়াজসহ একাধিক লেখক ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিছু অমোঘ সতর্কবাণী করেছিলেন। বইটি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতে অর্থনীতির অবস্থান কি রকম হতে পারে তার একটি গবেষণাধর্মী পাঠ। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির ছত্রছায়ায় দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের বর্ণনা আছে এতে।

আগামী দিনের অর্থনীতি যে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে, তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী এই বইতে উল্লেখ রয়েছে। সাবেক শাসকের অর্থনৈতিক সংকটের স্বরূপ—বিশেষ করে ব্যাংক, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের লাগামহীন দুর্নীতি, অপচয় এবং বিপুল অর্থ পাচারের চিত্র তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ের নিবন্ধগুলোতে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে এর সঙ্গে সুশাসনের অভাবের সম্পর্কও। সংকটের গভীরতা ও ভবিষ্যতের বিপদ বুঝতে এই বই পাঠ জরুরি।
 
এছাড়াও আগস্টেই বাজারে এসেছে লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের নতুন বই 'জামায়াতে ইসলামী: উত্থান বিপর্যয় ও পুনরুত্থান'। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে বুঝতে হলে আমাদের এই বিপুল শ্রমসাধ্য কাজটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

সাম্প্রতিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানকে বুঝতে গেলে আরেকটি বই আমাদের অবশ্য পাঠ্য, সেটি হলো অনুপম দেবাশীষ রায়ের লেখা কালকের আন্দোলন আজকের আন্দোলন। বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনের আগে ও পরের আন্দোলনগুলার রূপ ও গতি কীভাবে বদলিয়েছে, কতটা সফল হয়েছে বা হয়নি থেকে শুরু করে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট–সবকিছুর কথা এ বইটিতে আছে।

এই বইয়ের মূল আলোচ্য– শাহবাগ গণজাগরণ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নো-ভ্যাট মুভমেন্ট ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনগুলো। বইটিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রচলিত গণআন্দোলন কিভাবে ডিজিটাল চরিত্র পেয়েছে এবং প্রথাগত চরিত্র বদল করেছে! বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য, রাজনৈতিক প্রবণতা অনুসন্ধানের জন্য, তরুণ প্রজন্ম বা জেন-জি এর নেতৃত্বে আন্দোলনগুলো নিয়ে সমাজে এর প্রভাব বুঝতে এই বিশ্লেষণ অবশ্যই আমাদের মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার।
 
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠের খোঁজ নিয়ে জানলাম কিছু বই পাঠক মহলে খুব আলোচিত। যেমন- লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি, প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বিএনপি সময়-অসময়, বেলা অবেলা, জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি (মহিউদ্দিন আহমদ), স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ (পিনাকী ভট্টাচার্য), মূলধারা ৭১ (মইদুল হাসান), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, র এবং সিআইএ (মাসুদুল হক), মুজিববাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ (আলতাফ পারভেজ), আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর (আবুল মনসুর আহমদ), শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল (মওদুদ আহমদ), শতাব্দী পেরিয়ে (হায়দার আকবর খান রনো), বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ (বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন), বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ (অ্যানথনি মাসকারেনহাস- অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান) এবং বাঙলাদেশের অভ্যুদয় (বদরুদ্দিন উমর) দুটি খণ্ড ইতিহাস হিসেবে অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত।
 
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি বই পড়তে গিয়ে কাকতালীয় একটি ব্যাপার চোখে পড়ল। দেশের রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারের সর্বশেষ বইয়ের নাম গণভ্যুত্থান ও গঠন। রাষ্ট্রচিন্তা থেকে প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন প্রকাশনা। বইটি পড়ার শুরুতেই খেয়াল করি- বইটির ভূমিকা লেখা হয়েছে ৫ই আগস্ট ২০২৩। পাঠক হিসেবে কৌতুহলী মন চলে যায় ওই তারিখটিতে। ঠিক এক বছর পরে যে তারিখে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হলো! বইটি ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারো কারো পাঠ্য ছিলো বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা গেছে।
 
একটি সহিংস জনযুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন হওয়া জাতি আমরা। জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে বই আমাদের পড়তেই হবে। এই ভূখণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশ জানতে রাজনৈতিক ইতিহাসধর্মী বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দিন ৫ই আগস্ট ফেসবুকে দেখেছি দুটো বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা 'ভাইরাল' হতে। একটি হলো শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল, আরেকটি জহির রায়হানের আরেক ফাগুন। ক্রাচের কর্নেল বইটির যে বাক্যটি  ভাইরাল হয়, তাতে লেখা আছে- মর্মাহত তাহের ঘরে গিয়ে লুৎফাকে বলেন: কেবল স্বাধীন হলো একটি দেশ,  কীভাবে লুটপাট শুরু হয়ে গেল দেখ। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অরাজক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে যায় শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল বইয়ের লুৎফা ও তাহেরের সংলাপে। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে তাহেরের আক্ষেপ দেখে আমরা এখন বুঝি, চলতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে অরাজক অবস্থাটা নতুন কোনো দৃশ্যায়ন নয়।
 
এদিকে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তীব্র আন্দোলনে বসে দেখতে পাই জহির রায়হানের আরেক ফাগুনের একটি বাক্য- আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব। জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প। ভাষা আন্দোলনকারীদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়!' জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে। ও কথা শুনে একজন বললেন, 'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।
 
এভাবেই দেখেছি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাঁক বদলে বই, বিশেষত রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিশ্লেষণধর্মী বই হয়ে উঠেছে আলোচনার বিষয় হিসেবে। যোগাযোগবিদ্যার সাবেক শিক্ষার্থী বা সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে আমার আগ্রহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ। এ লক্ষ্যে ছাত্র জীবন থেকেই আমি গত ২৫ বছর ধরে নিজের ঘরে সুপরিসর লাইব্রেরি গড়ে তুলেছি। এতে ভিন্নমতের বইয়ের পাশাপাশি নানান একাডেমিক বইও রয়েছে।

বইপড়ার প্রতি জোর দিয়ে এই লেখার শেষে আমি স্মরণ করতে চাই অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। যিনি বলেছেন- বই মেলায় গেলে পাশাপাশি সাজানো বইয়ের দিকে তাকালে বইমেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ার কথা, তা হলো সহিষ্ণুতা। একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্যের বইয়েরা নির্বিবাদে সহাবস্থান করে, যেমনটি সমাজে থাকার কথা, রাষ্ট্রে থাকার কথা।
 
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক একটি পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৬ বছরের শাসক দেশ ছেড়েছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও একক ভাষাভিত্তিক  রাজনৈতিক দলের প্রচণ্ড প্রতাপশালী নেতারা দেশ ছেড়েছেন বা আত্মগোপনে আছেন। এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি পৃথিবীর ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল। আক্ষরিক অর্থেই মসনদ কাঁপানো এই আন্দোলনের ফলে একটি নতুন প্রজন্ম মুখোমুখি হয়েছে ইতিহাসের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও এরকম কিছু দিন বদলের স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলো এই জাতির ভাগ্যাকাশে। এবারের গণঅভ্যুথানে শাসক পালিয়েছে এটি সত্যি, কিন্তু মানুষের মননজগতে যে  ক্ষয়ক্ষতি আর ট্রমা —সবকিছুর ব্যাপকতা অভূতপূর্ব। বছরের মাঝামাঝি বর্ষাসিক্ত এই ভঙ্গুর চব্বিশ সাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না, কিন্তু যেখানেই নিয়ে যাক; আমরা যেন ইতিহাস পাঠ থেকে মুখ না ফেরাই।
 
তীব্র ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফলে উল্লসিত বা উদ্বিগ্ন দুই শ্রেণির পাঠককেই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠে মন দিতে হবে। ইতিহাসকে জানতে হবে বর্তমানকে বোঝার জন্য। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে সমব্যথী মন নিয়ে নির্মোহ ইতিহাস অনুসন্ধানী মন তৈরি করতে হবে। একটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্থের ভবিষ্যত দেখতে চায় যারা, সেই চাওয়া পূরণের একটি বড় উপলক্ষ এখন রাজনৈতিক ইতিহাসরধর্মী বইপাঠ।

লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

                                 

বার্তায় মতামত আরো

২০২৫ সালের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যেমন হবে

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন-পরবর্তী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কী হতে পারে, তা নিয়ে ততই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে। এর উত্তর অনিশ্চয়তার আবরণে মোড়ানো আছে।

প্রথমত, নির্বাচনে কে জিতবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। গ্রীষ্মের শুরুতে, জরিপগুলো দেখাচ্ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু যখন বাইডেনের জায়গায় ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন জনসমর্থনের গতিপথ ঘুরতে শুরু করল। তখন আবার জরিপে কমলাকে ট্রাম্পের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে।

এখন সমস্যা হলো, ভোটারদের অনুভূতি যদি এত দ্রুত বদলাতে পারে, তাহলে আগামী ৫ নভেম্বর নাগাদ তাঁদের সেই পছন্দ–অপছন্দের দোলাচল কোথায় গিয়ে স্থির হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব।

যদিও কমলা হ্যারিস বেশ চমক দেওয়ার মতো রাজনৈতিক দক্ষতা দেখাচ্ছেন; তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে চমকের শেষ বলে কিছু থাকে না। এখানে যখন-তখন যা কিছু ঘটতে পারে।

দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মার্কিন নাগরিকদের পাশাপাশি এই অর্থে বিদেশি নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও ‘ভোট’ আছে যে বিদেশি নেতা ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আচরণ ও কর্মকাণ্ড আচমকা মার্কিন এজেন্ডা ও বিভিন্ন ফলাফলের সম্ভাবনাকে পাল্টে দিতে পারে।

যেমন জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যে পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা দিয়েছিলেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের (নাইন–ইলেভেন)
সন্ত্রাসী হামলার পর সেসব নীতির কিছুই তিনি আর অনুসরণ করেননি।

ঠিক সেভাবেই ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা সি চিন পিংয়ের আচরণ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কখন কী চমক আনবে, তা কে বলতে পারে।

সবচেয়ে বড় পার্থক্যগুলোর অন্যতম হলো ইউরোপ অবস্থান নিয়ে। ট্রাম্প এবং তাঁর রানিংমেট জে ডি ভ্যান্স স্পষ্ট করেছেন, ইউক্রেন এবং ন্যাটোকে সমর্থন করার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ কম। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। ইউক্রেনকে নাটকীয়ভাবে দুর্বল না করে এটি কীভাবে করা যাবে, তা বোঝা কঠিন।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানের বিবৃতি থেকে অবশ্যই একজন নেতার নীতি সম্পর্কে কিছু না কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অনেকে আশা করতে পারেন, কমলা হ্যারিস জয়ী হলে বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে।

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় থিম হলো বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া। কমলা অবশ্য বাইডেনের এই নীতি প্রচারের ওপর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিচ্ছেন, যদিও তিনি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ব্যাপারে বাইডেনের চেয়ে আরও বেশি কিছু বলেছেন। তবে তিনি মার্কিন জোটকে শক্তিশালী করার এবং বহুপাক্ষিকতার প্রচারের কাজে বাইডেনের নীতি অনুসরণ করবেন বলে মনে হচ্ছে।

ট্রাম্পের নীতি অনিশ্চিত। যদিও সব রাজনীতিবিদই কী করবেন, কী করবেন না—সে বিষয়ে কিছুটা ফাঁক রেখে দেন। কিন্তু ট্রাম্প এ ব্যাপারে কুখ্যাত। তাঁর কোন বক্তব্য যে তাঁর নীতি, আর কোনটা নয়, তা জানা কঠিন।

একতরফাবাদের প্রতি তাঁর সমর্থন এবং জোটভিত্তিক ও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কমজোরি করার বিষয়ে তাঁর ভাষণ ও কথাবার্তা তাঁর বিদেশনীতির ব্যাপারে আমাদের একটা ধারণা দেয় বটে, তবে তা সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয় না।

প্রার্থীরা তাঁদের উপদেষ্টা হিসেবে কাকে কাকে নিয়োগ দিয়েছেন, তা দেখে অনেক সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীকে জোরালো করার চেষ্টা করেন।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, তাহলে আমরা দেখতে পাই, কমলা হ্যারিসের পররাষ্ট্রনীতির মাথা হলেন ফিলিপ গর্ডন। ফিলিপ একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত একজন মধ্যপন্থী নেতা, যিনি কমলার প্রধান পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা হওয়ার আগে ডেমোক্রেটিক প্রশাসনে ইউরোপীয় ও মধ্যপ্রাচ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করেছিলেন।

বিপরীতে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কে হবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না; যদিও সংবাদমাধ্যমগুলো মাঝেমধ্যে ট্রাম্পের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েনের কথা উল্লেখ করছে।

আমরা জানি, ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদে তাঁর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে যে প্রথাগত রিপাবলিকানদের নিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের জন্য তাঁকে অনুশোচনা করতে হয়েছিল। কারণ, ওই উপদেষ্টারা নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করেছেন, যা ট্রাম্পের কাজের স্বাধীনতাকে হ্রাস করেছিল।

ট্রাম্প তাঁর নীতিগুলোকে যতটা আক্রমণাত্মক ও পক্ষপাতমূলক করতে চেয়েছিলেন, ওই উপদেষ্টাদের কারণে তিনি তা করতে পারেননি। তাঁদের কারণে ট্রাম্পকে তাঁর নীতিগুলোকে অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী করতে হয়েছিল।

দুই প্রার্থীর মধ্যে লক্ষ করার মতো কিছু মিল রয়েছে। চীন সম্পর্কে তাঁদের অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই শিবিরের মধ্যে কিছু বিষয়ে অভিন্ন মত রয়েছে। এর একটি হলো চীন ইস্যু।

কমলা ও ট্রাম্প দুজনই মনে করেন, চীন বাণিজ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি ইস্যুতে ন্যায্য ভূমিকা পালন করেনি। তাঁরা দুজনই মনে করেন, পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী আচরণ জাপান ও ফিলিপাইনের মতো আমেরিকান মিত্রদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন বহুবার বলেছে, তারা তাইওয়ানকে একটি অবাধ্য প্রদেশ হিসেবে মনে করে এবং তাইওয়ানের ওপর নিজেদের পূর্ণ দখল প্রতিষ্ঠিত করতে তারা দ্বীপটিকে প্রয়োজনে সর্বাত্মকভাবে দখল করে নেবে।

চীনের মতো অনেকগুলো ইস্যুতে বাইডেন ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করে এসেছেন এবং কমলা হ্যারিসও সম্ভবত সেই পথেই হাঁটবেন।

এই দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় মিল হলো, তাঁরা দুজনই নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মার্কিন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথাগত (রিগান যুগের) রিপাবলিকান পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছিলেন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়েছিলেন। এর সবই করা হয়েছিল মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইথাইজারের নির্দেশনায়, যিনি এখনো ট্রাম্পের বলয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে রয়েছেন।

 পূর্বসূরি ওবামা উদ্যোগ নিয়ে যে ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে সেই অবস্থা থেকে সরে এসেছিলেন। ট্রাম্পের পর বাইডেন ক্ষমতায় এসে ট্রাম্পের সরে আসা চুক্তিতে ফিরে যাননি এবং চীন থেকে পণ্য আমদানিতে ট্রাম্প যে বাড়তি কর আরোপ করেছিলেন, সেটিও বাতিল করেননি।

আসলে বাইডেন চীনের বিরুদ্ধে নতুন প্রযুক্তিকেন্দ্রিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করে চীনবিরোধিতায় আরও এগিয়ে যান (যেটিকে ‘একটি ছোট উঠানকে ঘিরে ফেলার জন্য চারপাশে অনেক উঁচু বেড়া’ দেওয়া বিল হিসেবে বলা হয়ে থাকে)।

কমলা হ্যারিস জিতলে সেই বেড়ার উচ্চতা কমাবেন বলে মনে হয় না। আর ট্রাম্প জিতলে সেই ‘ছোট উঠানের’ পরিধি আরও বাড়াবেন বলে মনে হচ্ছে।

এ ছাড়া ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস উভয়ই প্রতিরক্ষা বাজেট এবং প্রতিরক্ষা শিল্প খাতে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে আমেরিকান ‘হার্ড পাওয়ার’ আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উভয়ই বর্তমান পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকীকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। দুজনেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিকাশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

তবে দুজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যগুলোর অন্যতম হলো ইউরোপ অবস্থান নিয়ে। ট্রাম্প এবং তাঁর রানিংমেট জে ডি ভ্যান্স স্পষ্ট করেছেন, ইউক্রেন এবং ন্যাটোকে সমর্থন করার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ কম। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। ইউক্রেনকে নাটকীয়ভাবে দুর্বল না করে এটি কীভাবে করা যাবে, তা বোঝা কঠিন।

মধ্যপ্রাচ্যে উভয় প্রার্থীই ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং আত্মরক্ষার অধিকার বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; যদিও কমলা হ্যারিস ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথাও বলেছেন।

উভয়ই সম্ভবত সৌদি আরবকে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কাজ এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাবেন। উভয়েই ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবেন।

তবে ট্রাম্প আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকাকে কম অগ্রাধিকার দিলেও কমলা হ্যারিস ওই অঞ্চলগুলোতে আরও মনোযোগ দেবেন বলে আশা করা যেতে পারে।

জোসেফ এস নাই অ্যাস্পেন স্ট্র্যাটেজি গ্রুপের কো-চেয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

2024-09-09

সংস্কার হবে এমন, জনগণ যেন বুঝতে পারে রাষ্ট্রের মালিক তারাই

বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের যেভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, সেগুলোর সংস্কার করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এক মাস সময়ের মধ্যে আমলাতন্ত্র ও পুলিশকে সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য।

চলমান মব-জাস্টিস ও সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী? রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে মামলা হচ্ছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এগুলোসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনারা সংস্কারের কথা বলছেন। কোন কোন জায়গায় কী কী সংস্কার আনতে চান?

আলী ইমাম মজুমদার: জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ বিষয়ে কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমন: ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে হয়, এ সংস্কৃতিটা আমার ভুলতে বসেছিলাম। এটা আমাদের সংস্কার কাজের অন্যতম বিষয়। এর বাইরে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন নিয়ে কাজ করতে হবে।

প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা বা ভালো পোস্টিং না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যারা (বিগত সরকারের সঙ্গে) তাল মিলিয়ে চলেছে, সেটা একটা বিষয়। কিন্তু তাদের একটি অংশ চরম দলবাজী করেছে, অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা (রাজনৈতিক) দলের নেতাকর্মীদের মতো আচরণ করেছে। পত্র-পত্রিকায় দলদাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে আমরা দেখেছি।

অন্যদিকে পুলিশের প্রতি মানুষের রোষ আমরা দেখেছি। তবে পুলিশ সদস্যকে মেরে টাঙিয়ে রাখার ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটি বেদনাদায়ক ব্যাপার। হয়তো মব সবক্ষেত্রে সঠিক ছিল না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনটা হয়েছে। যেমন: ফরাসি বিপ্লব।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড় করানোর যে প্রচেষ্টা, সেটাই সংস্কার। মানুষ কী চায়? সেবা চায়। কীভাবে চায়? সহজে পেতে চায়। এই কাজটাই আমরা করতে চাই, যেন জনগণ বুঝতে পারে রাষ্ট্রের মালিক তারাই। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে যাতে স্বেচ্ছাচারিতা চেপে না বসে, তা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করার কাজটা আমরা করে যেতে চাই।

ডেইলি স্টার:  এর জন্য কত সময় লাগতে পারে?

আলী ইমাম মজুমদার: প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ যতদিন এই সরকারকে দেখতে চাইবে, ততদিন দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রেখেছেন।

ডেইলি স্টার: আমলাতন্ত্রের অনেকের মধ্যে ভয় কাজ করছে। ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না।

আলী ইমাম মজুমদার: এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমার মনে হয় অবস্থা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ভীতি বা শঙ্কার ক্ষেত্রে বলব, যারা ভালো কাজ করেছেন, তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা দলীয় ক্যাডারের মতো কাজ করেছে, তাদের জন্য কিছুটা এরকম থাকবে। যারা দলদাসের মতো আচরণ করেছে, তারা খেসারত দেবে। কিছুক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি দ্রুতই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

একটি সরকারের পুরো সিস্টেমকে পৃথিবীর কোনো দেশেই পরিবর্তন করা হয় না। যেমন: স্পয়েল সিস্টেম আমেরিকায় আছে, সেটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদগুলোর জন্য। অর্থাৎ আমেরিকাতে সরকার বদলের পর সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা বদল হয় না।

ডেইলি স্টার: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সরকার আপনারা। আমলাতন্ত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের...

আলী ইমাম মজুমদার: বৈষম্য না রাখতে পারলে আমি খুবই খুশি হবো। কিন্তু এটাতে কাজ করতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। কতটা সম্ভব এখনই বলতে পারছি না।

আবার এটাও ঠিক, সব চাকরির ক্যারিয়ার অপরচুনিটি সমান না। যেমন: যারা বিসিএস ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন, তারা বিদেশে পোস্টিংয়ের সময় দুই সন্তানের পড়াশোনার জন্য পৃথক খরচ পান। এর বাইরেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। যেটা দেশে চাকরি করা কর্মচারীরা পান না।

বিসিএসে দুই ভাগে জেনারালিস্ট ক্যাডার ও বিশেষায়িত ক্যাডার নিয়োগ হয়। বিশেষায়িত ক্যাডারদের অনেক ভাগ। বিষয়টি জটিল, যা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এজন্য পদোন্নতি জটিলতা বেশি।

ডেইলি স্টার: কিন্তু প্রশাসন, পুলিশসহ কয়েকটি ক্যাডারে শূন্যপদ না থাকলেও ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হচ্ছে...

আলী ইমাম মজুমদার: আমি মনে করি অন্যান্য ক্যাডারের সমপর্যায়ে থাকা অফিসারদেরও পদোন্নতি পাওয়ার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি আদেশও আছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে (এসএসবি) কাজ হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও চাওয়া হয়েছে।

আমি এতটুকু বলতে পারি, সরকার নির্মোহভাবে কাজ করছে। আমি এখন কোনো চাকরি করছি না, কোনো ক্যাডারেও বিলং করছি না। আমি সবার দিকটাই দেখছি। যদি তাদের পদোন্নতির পক্ষে মত আসে, তাহলে অবশ্যই অন্যরাও (আদার্স ক্যাডার) পদোন্নতি পাবে।

আইন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেই। সেখানে জুডিশিয়ারিসহ লেজিসলেটিভ বিভাগের অফিসাররা কাজ করেন। আশা করি সেখানে এই বিষয়টা নির্মোহভাবে পরামর্শ আসবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার।

ডেইলি স্টার: আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব পুলে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করতে চান।

আলী ইমাম মজুমদার: আমার মনে হয় উপসচিব পুলে যে হার আছে (৭৫/২৫), এখানে সংস্কার আসতে পারে। সেটা আলোচনা সাপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

ডেইলি স্টার: সরকারের দায়িত্বশীলদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে কি?

আলী ইমাম মজুমদার: উপদেষ্টাদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার চিন্তা আছে। অন্য কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে কি না, এখনই তা বলতে পারছি না। ১৬ লাখ কর্মচারীর সম্পদের হিসাব ব্যবস্থাপনা কঠিন কাজ। সবকিছু একসঙ্গে করা যাবে না। তবে কারো বিরুদ্ধে পত্রিকায় বা অন্যভাবে অভিযোগ জমা পড়লে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

সাবেক সিনিয়র সচিব, আইজিপি ও এনবিআর সদস্যের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে সরকারের সহানুভূতি থাকবে না। দুর্নীতিবাজ কোনো সরকারের জন্যই উপকারী নন।

ডেইলি স্টার: মব জাস্টিস বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?

আলী ইমাম মজুমদার: এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এসব বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে।

ডেইলি স্টার: আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাদের সাবেক বসদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করতে পারবে কি?

আলী ইমাম মজুমদার: পুলিশ সব তদন্ত খারাপ করে না। যেমন: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুলিশ ভালো তদন্ত করেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিকল্প উদ্যোগ নেওয়া যাবে কি না, সেটা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভালো বলতে পারবেন। তা ছাড়া সব অপরাধের তদন্ত শুধু পুলিশ করবে না। দুর্নীতির অভিযোগগুলো দুদক তদন্ত করবে।

ডেইলি স্টার: গণহারে মামলা হচ্ছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে...

আলী ইমাম মজুমদার: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া হত্যা মামলা হওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আন্দোলনটাকে ওই পর্যায়ে নেওয়ার জন্য কিছু সাংবাদিকের করা প্রশ্ন কি দায়ী নয়? এই জাতীয় লোকদের বিষয়ে মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা থাকাটা অস্বাভাবিক না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি সেল গঠন করেছে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন। মামলাগুলো যাচাই-বাছাই করে যেসব মামলায় যাদের সম্পৃক্ত হওয়া অযৌক্তিক প্রমাণিত হবে, সেগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

ডেইলি স্টার: সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। ২০০১ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে মাইনরটি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের।

আলী ইমাম মজুমদার: কয়েকদিন দেশে কোনো সরকার ছিল না, তখন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা প্রথমেই গুরুত্ব দিয়ে নৈরাজ্য পরিহারে কঠোর বার্তা দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমার জানামতে প্রতিটা ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে, অনেক জায়গায় গ্রেপ্তারও হয়েছে।

শুধু সংখ্যালঘু নয়, সমাজের দুর্বল অংশের ওপর নির্যাতন হয়। তাই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, এই দেশের নাগরিক বা মানুষ হিসেবে বিচার চাওয়া সবার অধিকার। আমরা এই জায়গায় সুবিচার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে চাই, যাতে কেউ তার ধর্মের পরিচয়ে নয়, নাগরিক হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জায়গায় নিজের পরিচয় খুঁজে পায়।

2024-09-09

নদীভাঙনে দিশেহারা মানুষ, পাশে চাই অন্তর্বর্তী সরকার ও সর্বস্তরের সবাইকে

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের চর খিতাব খাঁ গ্রামটির একটি অংশ এখন তিস্তা নদীর বুকে। ২০২১ সাল যখন সেখানে ভাঙন তীব্র হয়, তখনই যদি তা রোধ করা যেত, তাহলে দৈর্ঘ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার ও প্রস্থে আড়াই কিলোমিটার অংশ নদীতে বিলীন হতো না।

যে অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে তার মোটামুটি আর্থিক ক্ষতির ধারণা পাওয়া যায়। জমি, বাড়ি, বাগান, পুকুরসহ হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।

মাত্র ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করলে সেখানকার ভাঙন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হতো। এখনো সেখানে নদী ভাঙছে এবং কবে এ ভাঙন বন্ধ হবে তা অনিশ্চিত। এতে যে আরও হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে না, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

ভাঙনকবলিত স্থান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছোট নদী কোটেশ্বর। উজান থেকে আসা ছোট নদীতে আছে একটি স্লুইসগেট। স্থানীয়দের আশঙ্কা, ভাঙতে ভাঙতে তিস্তা নদী এ পর্যন্ত এসে পড়লে অনেক জনপদের ক্ষতি হবে। তবে, এসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে কথা হয় ৭০ বছর বয়সী আব্দুল খালেকের সঙ্গে। বছর দুয়েক আগে তার ঘর তিস্তায় বিলীন হয়। পাকা ওই ঘরে ১২টি কক্ষ ছিল। এরপর নদীর পাশে অন্যের জায়গায় একটি টিনের ঘর তোলেন তিনি। একটি ঘরে স্ত্রী, মেয়ে, ছেলে, ছেলের বউ সবাই থাকেন। ঘরের ভেতরে লম্বা কাপড় দিয়ে পার্টিশন তৈরি করেন।

এ বছর আবারও নদী ঘরের কাছে চলে এসেছে। ঘরে যে কয়টা সামান্য জিনিসপত্র আছে তা রাখার জায়গা পাচ্ছেন না বৃদ্ধ খালেক। বাড়ি ভেঙে গেলে কোথায় থাকবেন জানেন না।

আব্দুল খালেক টলমল চোখে নিজের জীবনের কথা বলছিলেন। জানালেন, সরকারিভাবে জমি কিংবা ঘর কিছুই পাননি। তার পাশেই বসেছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শহীদুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, 'হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হইছে এই গতিয়াশামে। সরকার একজনকেও একটা ঘর দেয় নাই। জমি দেয় নাই।'

যেখানে বসে কথা বলছিলাম তার পাশেই ছোট্ট একটি টিনের চালা। সেটি মূলত রান্নাঘর। ওই রান্নাঘরে একটি পরিবার বাস করছে। স্থানীয়দের কাছে জানলাম, ওই এলাকার ভোটার ছিলেন ৩ হাজার ৮০০ জন। নদী ভাঙনের পর এখন ভোটার মাত্র ৮০০। সেখানে বাড়ি ছিল ১ হাজার ৭৫টি। তার মধ্যে ৮০০ বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন। অনেক পাকা সড়ক, মসজিদ, স্কুলসহ অনেক স্থাপনাই এখন নদীগর্ভে।

এমন অবস্থা তিস্তাপাড়ের কেবল একটি স্থানে। এখানে ভাঙনপ্রবণ এলাকা প্রায় ৩২ কিলোমিটার। ভাঙন রোধে সরকার সবসময় দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে।

সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যা। এ বন্যায় মানুষ মারা গেছেন ৬৯ জন। এর ক্ষতিপূরণ হবে না। সরকারের পাশাপাশি সারাদেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ এই বন্যায় যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের সবাই একদিনের বেতন দিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পূর্বাঞ্চলীয় বন্যায় সহায়তাকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রংপুর অঞ্চলের মানুষেরা একটি প্রশ্ন তুলেছেন। রংপুর অঞ্চলের জেলাগুলোতে যখন প্রচণ্ড বন্যা হয়, ভাঙন হয় তখন কি সারাদেশের মানুষ এভাবে পাশে দাঁড়ায়? কিংবা এর একশ ভাগের একভাগও কি পাশে দাঁড়ায়? এখন যে ভয়াবহ ভাঙন চলছে এগুলোর কি কোনো আলাপ আছে কোথাও?

রংপুর অঞ্চলের বন্যায় একেবারেই মানুষ পাশে দাঁড়ায় না এ কথা বললে ভুল হবে। ২০১৭ সালে বন্যার্তদের পাশে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিল। এরপর কমতে কমতে এখন আর তেমন কেউ দাঁড়ায় না।

এ অঞ্চলের বন্যার খবরগুলো গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার করা হয়, সেখানেও বৈষম্য আছে। টেলিভিশনে হলে অধিকাংশ সময় দেখা যায় বিকেলের গ্রাম জনপদের খবরে, আর পত্রিকায় হলে উত্তরাঞ্চল কিংবা রংপুর সংস্করণে। ফলে কাগজের খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না। অধিকাংশ গণমাধ্যম আগের সরকারের মুখপাত্র হওয়ার কারণে বন্যার্তদের সহায়তা না দেওয়ার খবরগুলো তেমন প্রচার করা হতো না।

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী জেলার ভাঙন রোধে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা মনে করি। সাধারণ মানুষও এই ভাঙন রোধে অংশ নিতে পারে। যে মানুষগুলো বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের জমি কিনে দেওয়া যেতে পারে। যে স্থানগুলোতে ভাঙছে সেগুলোতে নিজেদের তদারকিতে জিও ব্যাগ ফেলে সাময়িক ভাঙন ঠেকানো সম্ভব। শুষ্ক মৌসুমে ব্লক দিয়ে ভাঙন রোধ করা সম্ভব। যেমন, উল্লিখিত চর খিতাব খাঁ এলাকা তিস্তার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এই মুহূর্তে ১৫-২০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই অল্প টাকায় ওই গ্রামের প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো উদ্যোগে এই টাকা পাওয়া গেলে ওই স্থানে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।

শুধু এখানকার ভাঙন নয়, সব ভাঙন রোধ করতে হবে। আগুনে পুড়ে গেলে জমি থাকে। বন্যায় ক্ষতি হলেও কিছু রয়ে যায়। কিন্তু, নদী ভাঙনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। ভাঙনে অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা পরিমাপ করা গেলেও, মানবিক পর্যায়ে যে ক্ষতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারও বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানের কবর বিলীন হচ্ছে। মানুষের স্মৃতিময় ঠিকানা হারিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন কত স্বজন-বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দেয় তার ইয়ত্তা নেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রংপুর অঞ্চল বৈষম্যের তলানিতে পড়ে আছে। এ অঞ্চলের দারিদ্র্যতিলক দূর করতে হলে অবশ্যই এ এলাকার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ অঞ্চলের বন্যা ও ভাঙন দূর করতে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

2024-09-09

বৈষম্যে দূর করতে হলে কী করতে হবে?

বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এখনও তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকন্তু, তারা নিরাপত্তাহীন এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন শোষণ ও নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির শিকার।

১৯৪৮-এ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র বলে যে 'সকলেই যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী' (অনুচ্ছেদ ৭)। ১৯৬৫-এ সকল প্রকারের বর্ণবৈষম্যে নির্মূলের আন্তর্জাতিক কনভেনশন এর ১(১) অনুচ্ছেদ সংজ্ঞায়িত করে যে জাতিগত বৈষম্য অর্থ হচ্ছে জাতি, বর্ণ, বংশ, বা জাতীয় বা জাতিগত উৎসের উপর ভিত্তি করে যে কোনো পার্থক্য, বর্জন, বিধিনিষেধ বা পছন্দ। হানা শেফার্ড এবং দেবাহ পেজার-এর মতে '৭০ এর দশকের পর থেকে, 'প্রাতিষ্ঠানিক', 'কাঠামোগত', বা 'পদ্ধতিগত' বৈষম্য শব্দগুলির প্রয়োগ দেখা যায়, মার্কিন আইনের অধীনে।

তথাকথিত 'জাতি নির্দেশিকা', ২০০০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, 'পরোক্ষ বৈষম্য'-এর ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করে, যেখানে একটি আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ বিধান, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় একটি বিশেষ অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে রাখবে। বিপরীতে, 'প্রত্যক্ষ বৈষম্য' হল এমন পরিস্থিতি যেখানে একজন ব্যক্তির সাথে সরাসরি অন্যের তুলনায় কম অনুকূল আচরণ করা হয়।

কানাডিয়ান আদালত, 'পদ্ধতিগত বৈষম্য' হিসেবে চিহ্নিত করেছে, আচরণ, নীতি এবং কিছু চর্চার ফলাফল যা যে কোনো সংস্থার কাঠামোর অংশরূপেই প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অ্যামি এল শেপার্ডের মতে, এটি আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক মনোভাব এবং চর্চার একটি ধারা থেকে উদ্ভূত হয়, যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর প্রভাব সৃষ্টি করতে তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় বৈষম্যই জড়িত থাকতে পারে।

ক্রিস্টিন বুমিলার পর্যবেক্ষণ করেছেন যে শুধুমাত্র বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি প্রতিকার প্রদান বৈষম্য দূর করার জন্য অপর্যাপ্ত। গবেষণা দেখায় যে আক্রান্তরা প্রতিশোধের ভয়, আইনি প্রক্রিয়ার খরচ এবং দীর্ঘসূত্রিতা, এবং তার নেতিবাচক ফলাফলের ভয়ে কোনপ্রকার আইনি প্রতিকারের পথে এগোয় না। স্যান্ড্রা ফ্রেডম্যান শনাক্ত করেছেন যে ব্যক্তিগত মামলা সফল হলে, সাধারণত কাঠামোগত পরিবর্তনের পরিবর্তে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণের দিকেই পরিচালিত করে। কিছু দেশে বিভিন্ন ধরনের সম্মিলিত পদক্ষেপের উদ্যোগ দেখা গেলেও, এই ধরনের আইনি প্রক্রিয়া জটিল, দীর্ঘ, এবং ব্যয়বহুল - তাই বিরল।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।' ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) শুধুমাত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না। এবং (২) রাষ্ট্র ও জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। অথচ বাস্তবে বৈষম্য দূর করে, সমান কর্মসংস্থানের সুযোগের ধারণাটি বাংলাদেশে সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১; সিনিয়র সার্ভিসেস পুল, ১৯৭৯; বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস (পরিষেবার শর্তাবলী) বিধিমালা, ১৯৮০, এবং সরকারি কর্মকর্তা (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫ এখনও সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধক।

অনুচ্ছেদ ২৯ অনুযায়ী সাংবিধানিক বিধান রয়েছে যা ধর্মের উপর ভিত্তি করে যে কোনো ধরনের বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করে। প্রয়োজন অনুযায়ী নাগরিকদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণের জন্য ইতিবাচক বৈষম্যের ব্যবস্থা এবং সরকারি নীতিগুলিও নিশ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানে। দেওয়ানি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি-তে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রদান করে যে কোনো ধরনের বৈষম্য বা সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এখনও তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকন্তু, তারা নিরাপত্তাহীন এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন শোষণ ও নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির শিকার। সংবিধানের দ্বারা স্বীকৃত সমতার নীতি অনুপস্থিত, যখন অনুচ্ছেদ ১০ অনুযায়ী জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। অনুচ্ছেদ ১৯ অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৮৪ এবং ঐচ্ছিক প্রটোকল ১৯৯৮ বাংলাদেশকে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে এবং জাতীয় আইনে এর বিধান নিশ্চিত করতে এবং নীতিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করেছে।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ছাত্র ও জনগণের আন্দোলনের পর, কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বৈষম্য এখনও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীতি এবং আইনগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা এবং সংশোধন করা যথাশীঘ্র প্রয়োজন যাতে সমান এবং ন্যায়ানুগ নিয়মগুলো নিশ্চিত করা যায়। ইতিবাচক পদক্ষেপ, যেখানে প্রয়োজন, এখনই শুরু করা উচিত। সকল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং কর্মকর্তাদের বৈষম্যহীনতার প্রকৃত অর্থ এবং আইনের অধীনে এই লক্ষ্যে তাদের বাধ্যবাধকতা উপলব্ধি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

বৈষম্যহীন মূল্যবোধ প্রচারের জন্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করা উচিত। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পদ্ধতিগত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। গৃহীত সমস্ত পদক্ষেপের অগ্রগতি নিরীক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা উচিত। ছাত্র ও জনগণের দ্বারা যে বীজ বপন করা হয়েছিল, তা বাংলাদেশকে সেই শপথের দিকে রূপান্তরিত করবে যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, অর্থাৎ, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা জনগণের' - এবং শুধুই জনগণের!

ফাইয়াজউদ্দিন আহমদ: আইনজীবী এবং সামাজিক-আইন গবেষক

2024-09-09

কীভাবে এতটা নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হলাম আমরা?

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হওয়ায় আমরা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে অভিনন্দন জানাই। একইসঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার তদন্তে গত মঙ্গলবার গঠিত কমিশনকেও অভিনন্দন জানাই। পাঁচ সদস্যের এই কমিশন ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবে। হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এই কমিশন পুলিশ, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করবে। এসব গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্র, সরকার বা সমাজের সুরক্ষা দেওয়ার বদলে ভিন্নমত দমন, বিরোধীদের নির্মূল ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সরকারি নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিতে পারত, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ও জনবান্ধব উদ্যোগের একটি। এই উদ্যোগের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের অভিনন্দন জানাই। গণমাধ্যম, বিশেষত এই পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা কমিশনের অশেষ সাফল্য কামনা করছি। শুধু ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই হবে না। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

পরের কাজটির সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা বেশি। ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য বৃদ্ধি, বিশেষত, বিরোধীদলকে নির্মূলের কাজে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহারের এই চর্চা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ শুরু করেনি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বহুল ব্যবহারের এই চর্চা শেখ হাসিনার শাসনামলে চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও এর সূত্রপাত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সক্রিয় রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রবেশের মাধ্যমে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সত্তরের দশকের শেষের দিকে যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গঠন করা হচ্ছিল, তখন রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের এই দলে যোগ দিতে বাধ্য করার জন্য একাধিক নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের এক দশকের শাসনামলেও এই ধারাবাহিকতা অটুট ছিল। সেই সময় তিনি নিজেও এসব বাহিনী তার নিজের দল গঠনে ও বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগান। আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে এই অন্যায়ের অবসান ঘটবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, নির্বাচিত এই দুই দলের সরকারের আমলেও এই চর্চা অব্যাহত থাকে এবং এর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক অধ্যায়টি রচিত হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই হামলার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের নারী শাখার প্রধানসহ মোট ২৩ জন নিহত হন এই ঘটনায়।

অর্থাৎ, ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে গত তিন দশকে যখনই আমরা পর্দার আড়ালের কারসাজির বদলে স্বচ্ছ, নাগরিক-কেন্দ্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছি, তখনই নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপ বেড়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারগুলো জনগণের আস্থা হারিয়েছে। কীভাবে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী, জনপ্রিয় ও সুসংহত রাজনৈতিক দল ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বৃহৎ পরিসরে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল। এই নির্ভরতার মধ্যে ছিল তাদেরকে দলের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, যার একটি উদাহরণ ছিল দলের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ের নেতাদের মনোনয়নে তাদের অনুমোদন নেওয়া। বিষয়টি এতটাই প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ের উদীয়মান নেতাদেরকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'আশীর্বাদ' নিয়ে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হতো।

শেখ হাসিনার পতনের পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। তবে ২০১০ সালের পর থেকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল মানুষকে তাদের বাসা কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও গুম করে রাখা এবং পরিবারসহ কাউকেই এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানানোর সামান্যতম প্রয়োজনও বোধ না করা। কখনো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কোনো জায়গায় সেসব ব্যক্তির মরদেহ খুঁজে পাওয়া যেত। কখনো কখনো তারা বাড়ি ফিরে আসতেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা ভেবে নিশ্চুপ থাকতেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছরের জন্য নিখোঁজ থাকতেন কিংবা কখনোই ফিরে আসতেন না।

তাদের আপনজনের দুর্বিষহ অবস্থার কথা ভাবুন। মৃত্যু, তা যত নির্দয়ই হোক না কেন, সেটি একটি মর্মান্তিক সমাপ্তির বার্তা দেয়। কিন্তু গুমের ঘটনায় পরিবারটি আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকে। ভাবে, হঠাৎ একদিন দরজা খুলে দেখবে তাদের আপনজন ফিরে এসেছে, যিনি হয়তো কারো বাবা, স্বামী, সন্তান কিংবা বন্ধু। প্রতিবার কেউ দরজায় কড়া নাড়লেই এক চিলতে আশা জেগে ওঠে, আবার পর মুহূর্তেই সেই আশা দপ করে নিভে যেয়ে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। কল্পনা করুন, বছরের পর বছর এ ঘটনা ঘটেই গেছে।

স্বাধীনতার বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রেখে যদি বলি, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে একটি হলো জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। বিশেষত, ২০১০ সালের পর থেকে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে থেকেও মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বিগত বছরগুলোয় গুমের ঘটনাগুলো বেশ ভালো করে যাচাই ও নথিবদ্ধ করে রেখেছে। অধিকারের প্রধানকে জেলেও যেতে হয়েছিল, ঘটনাচক্রে যিনি এখন ড. ইউনূসের সরকারের উপদেষ্টাদের একজন। সংস্থাটির মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৭০৮ ব্যক্তিকে গুম করা হয়। তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বেঁচে ফিরেছেন। ১৩ শতাংশকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেছে এবং বাকি ৩০ শতাংশের ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। বাড়ি বা রাস্তা থেকে 'তুলে নেওয়ার' ঘটনার ৩১ শতাংশ র‍্যাব, ৩০ শতাংশ ডিবি, ২২ শতাংশ ডিজিএফআই (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গে র‍্যাব থাকত) এবং ১৪ শতাংশ পুলিশ ঘটিয়েছে।

২০২২ সালের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জায়মা ইসলামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অন্তত ৫২২ জনকে গুম করা হয়। যারা বেঁচে ফিরে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই আবারও সেই নারকীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কখনোই আর মুখ খোলেননি। তবে যে অল্প কয়েকজন কথা বলেছেন, তাদের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কাজনক পরিণতিই হয়েছে। ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা আমার দুই কানের লতির সঙ্গে ব্যাটারির ক্লিপ লাগিয়ে সুইচ চালিয়ে দেয়। ইলেকট্রিক শকে আমার কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়'। আরেকজন জানান, তাকে আটকে রাখার সময় তার হাতগুলো দেহের পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। দুই মাস থেকে শুরু করে আড়াই বছর পর্যন্ত এ ধরনের নির্যাতন চলেছে। তাদেরকে একটি আড়াই ফুট চওড়া, চার ফুট লম্বা ও পাঁচ ফুট উঁচু কক্ষে আটকে রাখা হতো। কক্ষটি এতই ছোট ছিল যে ভালো করে বসা বা দাঁড়ানোও যেত না। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। মাটির নিচে, অন্ধকার ও জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রেখেও সারাক্ষণ তাদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। কেবল মৌলিক চাহিদা পূরণ বা গোসলের সময় তাদের চোখ খোলা হতো।

সম্প্রতি আমরা 'আয়নাঘরের' যেসব গল্প জানতে পেরেছি, তা এক ভিন্ন মাত্রার নির্যাতন ও নির্মমতার চিত্র উন্মোচন করেছে। এসব ঘটনা মোটা দাগে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এতে কিছু গোপন কারাগারের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই জানতে পেরেছেন, যা পুরোপুরি নজরদারিবিহীন এবং কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়। এগুলো পরিচালিত হয়েছে সেখানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মর্জি বা সম্পূর্ণ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা অনুযায়ী। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে এ ধরনের গোপন কারাগারে আট বছর আটকে রাখা হয়েছিল এবং সরকারের পতন না হলে তারা সম্ভবত সেখানেই আটকে থাকতেন। আটকাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নেতা মাইকেল চাকমা টানা পাঁচ বছর (২০১৯-২০২৪ সাল) সূর্যের আলো দেখেননি।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গঠিত কমিশন ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য কাজ করবে। ডিজিএফআই যে ২৩টি কারাগারকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। যাদেরকে অবৈধ ও নিষ্ঠুরভাবে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের সবাইকে শিগগির পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।

আমরা যেন আর কখনোই এ ধরনের নিষ্ঠুর ও অমানবিকতায় নিমজ্জিত না হই, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে। চিরদিনের জন্য এই চর্চাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব কমিশন একটি স্পষ্ট আইনি কাঠামো গঠন করবে, যাতে গত ১৫ বছরে মানুষকে যেরকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি আর কখনো না হয়।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

2024-09-09

২০১১ সালে যেভাবে বাতিল হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার

সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। যদিও এর আগে নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটে।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, সেই সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করা হয়েছে।

গত ২৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে এই আবেদন করা হয়। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ জন এই রিভিউ আবেদন করেছেন। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৭ আগস্ট ২০২৪)

প্রসঙ্গত, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর মাস দেড়েক পরেই ৩০ জুন সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। যদিও এর আগে নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা প্রবাহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।

২০১০ সালেই বিএনপি বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক থাকবে না

২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য বিশেষ কমিটি গঠনের পরদিনই তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিশেষ কমিটি গঠনের সমালোচনা করে। আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

তারা বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে আবার ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের মতো কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ষড়যন্ত্র করছে।' সরকার আবার বাকশাল কায়েম করার পথে অগ্রসর হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি নেতারা।

যদিও আওয়ামী লীগ বা সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেবে, তা ওই সময়ে পরিষ্কার ছিল না। কোনো ইঙ্গিতও ছিল না। ফলে বিএনপি নেতাদের ওই মন্তব্য অনেকের কাছেই 'টু আর্লি' বলে বিবেচিত হয়েছিল।

২০১১ সালের মার্চে দৃশ্যপট পরিবর্তন

বিশেষ কমিটি গঠনের পরে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে কোনো আলোচনা হয়নি বা কমিটির ভেতরে আলোচনা হলেও বিষয়টি সাংবাদিকরা জানতে পারেননি। অন্তত ওই সময়ে কমিটির বৈঠকগুলো আমি নিয়মিত ফলো করলেও এই ইস্যুতে ভেতরে ভেতরে কী আলোচনা হচ্ছে সেটা ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।

২৪ মার্চ বিশেষ কমিটির বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয় এবং বৈঠক শেষে কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে 'মিডনাইট ল' বলে অভিহিত করে বলেন, 'একটা বিতর্কিত সংসদে কোনো দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই বিএনপি একা একা মধ্যরাতে এই বিল পাশ করেছে। এ নিয়ে কারো কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। এখন আমাদের কাছে বিষয়টা এসেছে। এটা খুবই জটিল। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করছি।'

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সুরঞ্জিত বলেন, 'আমরা কোনো কিছুই বাতিল করছি না। তাছাড়া এই ইস্যু নিয়ে আদালতে এখনও শুনানি চলছে। আমরা এ নিয়ে আরও আলোচনা করব।'

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ইস্যুতে বিরোধী দলের বক্তব্যকে তিনি 'দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য' বলেও অভিহিত করেন। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে রসিকতা করে বলেন, 'স্থানীয় সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর মাঝখানে জমিরউদ্দিন সরকার—এই নিয়া আছি, বুঝছ?'

সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞরা কী বলেছিলেন?

২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশেষ কমিটি। এদিন সকাল-বিকাল দুই বেলা বৈঠক হয়। সকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতিদের সঙ্গে এবং বিকালে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে।

বৈঠকে তাদের প্রায় সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে কোনো বিচারপতিকে নিয়োগ না দেওয়ার বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনের পরামর্শ দেন। তারা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়াটা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, 'বিচারপতিদের সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের মুলা ঝুলিয়ে রেখে তাদের সরকারের অনুগত করার চেষ্টা স্বাধীন বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। এ থেকে বিচারপতিদের রেহাই দেওয়া উচিত।'

বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. এম জহিরও। তার মতে, সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রধান দুই দলের সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করে তাদের হাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এটি আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না। এ ব্যবস্থায় কেউ প্রধান উপদেষ্টা থাকবেন না। রাষ্ট্রপতির অধীনে সরকারি ও বিরোধী দলের ১০ জনই হবেন উপদেষ্টা।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো লোক পাওয়া যায়নি বলেই বিচারপতিদের এই দায়িত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তিনি মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তারচেয়ে বড় কথা তিনি কতটা গ্রহণযোগ্য।

সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান না করার পক্ষে মত দিয়ে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, 'এতে বিচার বিভাগ বিতর্কিত হয়। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।'

তবে সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, 'এ সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এক মুহূর্তের জন্যও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা উচিত নয়।' তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করার পরামর্শ দেন।

মহাজোটের সঙ্গে বৈঠক

২৫ এপ্রিল বিশেষ কমিটির বৈঠক হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও গণতন্ত্রী পার্টির নেতারা বৈঠকে অংশ নেন।

প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান বাতিল করে এই ব্যবস্থার সংস্কার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন ও সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিধান প্রণয়ন করার প্রস্তাব দেয় জাতীয় পার্টি।

দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেন, 'এ ব্যবস্থাটি রাজনীতিবিদদের জন্য একটি কলঙ্ক তিলক। অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা সৎ হতে পারেন না, নির্বাচনে তারা কারচুপি করতে পারেন—তাই তাদের বিশ্বাস করা যাবে না। এ কারণে একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে থেকে রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। এ অপমানজনক ব্যবস্থাটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার একান্ত অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও বিরাজমান নির্বাচন ব্যবস্থায় এটাকে এখনই আমি বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দিচ্ছি না। তাহলে বিরোধী পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই যাবে।'

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে কোনো প্রস্তাব না দিলেও জোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা হলে ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করার দাবি জানায়।

শেখ হাসিনাও বলেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক থাকবে

২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করে বিশেষ কমিটি। সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে এই বৈঠক শেষে জানানো হয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এ বিষয়ে গণভবনে ব্রিফ করবেন। ফলে আমরা হুড়মুড় করে সবাই গণভবনে ছুটে যাই।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তারা তিন মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল এবং আগের সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা সম্ভব হলে বিচার বিভাগের বাইরে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান করার পক্ষেও মত দিয়েছেন। তাদের প্রস্তাব, সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নির্বাচিত হবেন। অথবা সরকারি ও বিরোধী দলের পাঁচ জন করে সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটিই ঠিক করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও অন্য উপদেষ্টা কারা হবেন।

তার মানে, ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল একরকম—যা কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি বদলে যায়।

নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক

২০১১ সালের ৩ মে বিশেষ কমিটির বৈঠক হয় দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। যাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাদের অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষক।

বৈঠক শেষে বেরিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগসীমার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলেছি।' তার মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব উপদেষ্টা নির্দলীয় না হোক অন্তত নিরপেক্ষ হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্ধারিত ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে সংসদ পুনরুজ্জীবিত করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।'

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জানান, বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা নানারকম প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেকে বলছেন এই ব্যবস্থার দরকার নেই। অনেকে বলেছেন দুই মেয়াদের পর এই বিধান উঠিয়ে দেওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান এই সরকার প্রসঙ্গে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়। এটার জন্য বড় দুটি রাজনৈতিক দল একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে কোনো লাভ হবে না, বরং সংঘাত আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা করে সংশোধন করা উচিত।'

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা নেই। এ অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে যতদিন এটা বহাল থাকছে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মনোনীত করতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।'

তিনি বলেন, 'কেয়ারটেকার একটা বিশেষ ব্যবস্থা। যদি এটিকে রাখতেই হয়, তাহলে এর নিয়োগ প্রক্রিয়া বদলাতে হবে। নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই ১০ জন নিরপেক্ষ ব্যক্তি পাওয়া যাবে।'

অধ্যাপক আসিফ নজরুল তার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতি যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদের মতামত নেন, সেরকম বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়েছে। এই খণ্ডকালীন সরকারকে নির্দলীয় বলা হলেও নিরপেক্ষ কোথাও উল্লেখ নেই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য কমিটিকে পরামর্শ দিয়েছি।'

বদিউল আলম মজুমদার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করার প্রস্তাব দেন। বলেন, এই প্যানেলই ঠিক করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন।

সম্পাদকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

২০১১ সালে ৪ মে বিশেষ কমিটি বৈঠক করে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সঙ্গে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যারা এই পদ্ধতি রাখার পক্ষে তারা এর প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের বাইরে দলনিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেন। কেউ কেউ অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার সুপারিশ করেন।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মত দেন। সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদও এই ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, 'তারা চারটি নির্বাচন করেছে, যেগুলো দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবং পূর্ণ মেয়াদ সরকার থেকেছে। তাছাড়া আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু পরস্পরকে বিশ্বাস করে না, সুতরাং রাজনৈতিক দলের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, গ্রহণযোগ্য হবে না।'

নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণেই এটা এসেছে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত একটা দল আরেকটি দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে বলে বিশ্বাস না করবে, ততক্ষণ এই ব্যবস্থা থাকতে হবে। যদিও এটা গণতন্ত্রের জন্য অপমানজনক।

তবে এই ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব দিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান। বাস্তবতার কারণেই আপাতত এ পদ্ধতি মেনে নিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আগামী এক মেয়াদ পরই এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত।'

একইভাবে জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ বলেন, 'সারা দুনিয়ার কোথাও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নেই। এটি একেবারেই তুলে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকেই দায়িত্ব দিতে হবে।'

আদালতের রায়ের পরে পরিস্থিতি ভিন্ন

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ইস্যুতে যখন বিশেষ কমিটির এইসব বৈঠক চলছিল, তার মধ্যেই ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

১৬ মে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠক শেষে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সংবিধান সংশোধন বিষয়ে তারা যে প্রতিবেদন সংসদে পেশ করবেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ বলে আদালতের রায়ের পরে কেউ কেউ এরকমও মত দিয়েছিলেন যে যেহেতু বিশেষ কমিটিতে বিরোধী দলের কোনো সদস্য নেই, তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আরেকটি বিশেষ কমিটি করা দরকার। কিন্তু এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সুরঞ্জিত বলেন, 'মানুষের মস্তিষ্ক কেবলই উর্বর। এমনিতেই এই বদ্বীপের মানুষের মস্তিষ্কের উর্বরতার খ্যাতি আছে।'

এর ১০ দিন পরে ২৬ মে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সুরঞ্জিত বলেন, 'আদালত একদিকে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে বাতিল করেছেন, আবার বলেছেন যে আগামী দুটি নির্বাচন এর অধীনে হতে পারে। এটা তো সাংঘর্ষিক। এটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের জন্য বেশ অসুবিধাজনক।'

আমরা জানতে পারি যে, কমিটি তাদের প্রতিবেদনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে এবং তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়ে কোনো কিছু রাখা হয়নি। বিশেষ কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছিলেন।

তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের সিদ্ধান্ত হলো কবে?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্তটি হয় ৩০ মে অনুষ্ঠিত বিশেষ কমিটির ২৬তম বৈঠকে। এদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত প্রায় পৌনে ৮টা পর্যন্ত সংসদ ভবনের তৃতীয় তলায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার কার্যালয়ে এ দীর্ঘ বৈঠক হয়। অর্থাৎ এই বৈঠকে সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম মূলত বোমাটি ফাটান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে দেন যে, 'তত্ত্বাবধায়ক বাতিল'। আবদুল মতিন খসরু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আগামীকাল (৩১ মে) দুপুরে মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে ব্রিফ করা হবে।

সাংবাদিকরা দৌড়ে সংসদের টানেলে এসে দাঁড়ান। কমিটির সদস্যরা বের হলেই যাতে ধরা যায়। শেখ সেলিম বের হবার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। সেলিম বলেন, 'আদালত একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বলেছেন এটা অবৈধ, আবার পর্যবেক্ষণে বলেছেন এই ব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদ থাকতে পারে। এ দুটি তো মেলে না। আমরা কেন ঝামেলায় যাব?' তিনি আরও বলেন, 'আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে আদালত যা বলেছেন সেটি রায় নয়, অভিমত। আমরা আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

শেখ সেলিমের এই কথা শুনে কমিটির অন্য সদস্যরাও আর ইতস্তত করেননি। আমীর হোসেন আমু, আবদুল মতিন খসরু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রাশেদ খান মেননও একই সুরে কথা বলেন। মতিন খসরু বলেন, 'আদালতের রায় শিরোধার্য, সবাইকে মানতে হবে।'

কমিটির সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আদালতের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক। সুতরাং এটা রাখার আর কোনো সুযোগ নেই।' তাহলে ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে। এ নিয়ে কোনো সংকট দেখা দেবে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল বলেন, 'সংকট থেকেই সমাধানের পথ বের হবে।'

কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে তখন আমাদের বলেছিলেন, সদস্যদের অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক আরও দুই মেয়াদ রাখার পক্ষে জোর মত দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালত অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। একটি অবৈধ সরকার ব্যবস্থার অধীনে আর কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান না রেখেই সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য বলেন। এই ইস্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কমিটির সদস্যদের দীর্ঘ বাহাস হয় বলেও কোনো কোনো সদস্য অফ দ্য রেকর্ড বলেছেন।

পরদিন ৩১ মে দুপুরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে অবশ্য ভিন্ন কথা বলেন। তারা সংবিধান সংশোধনে যে প্রতিবেদন সংসদে পেশ করবেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে কোনো সুপারিশ থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা সামগ্রিকভাবে এ বিষয়টা সংসদের উপর ছেড়ে দিয়েছি। সংসদই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এটুকু বলতে পারি, রায়ের পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাই। যেটি নাই সেটিকে আমরা নিয়ে আসতে পারব না।'

সংসদে প্রতিবেদন পেশ

২০১১ সালের ৮ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান লুপ্ত করে এ বিষয়ে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রেখে সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটির প্রতিবেদন সংসদে পেশ করা হয়। এ সময় কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার বিষয়ে বলেন, 'বিরোধী দল এ বিষয়ে সংসদে এসে কথা বললে সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে।'

তিনি বলেন, 'অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি গণতন্ত্র পরিপন্থী। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছেন। কমিটি এ রায় মেনে নিয়ে তাদের সুপারিশ তৈরি করেছে। তবে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংঘাত এড়াতে বিরোধী দল সংসদে এসে সাংবিধানিক পন্থায় যে প্রস্তাব রাখবে, তা নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে বলে কমিটি মনে করে।'

কমিটির প্রতিবেদনে ২২ নম্বর সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে ২ক পরিচ্ছেদে (অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ৫৮ঙ) বিলুপ্ত করা হয়। একই সঙ্গে ৪৭ নম্বর সুপারিশে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ থেকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের 'প্রধান উপদেষ্টা'র সংজ্ঞা এবং অন্যান্য উপদেষ্টার সংজ্ঞাও বাতিল করা হয়। একইভাবে আরও যেসব জায়গায় 'প্রধান উপদেষ্টা' এবং 'উপদেষ্টা' শব্দগুলো আছে সবই বিলুপ্ত করা হয়।

২৫ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের প্রস্তাব করেই সংবিধান সংশোধন বিল সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এটা সংবিধানে সাংঘর্ষিক। কেননা সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবেন। যে কারণে আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার সুযোগ নেই।'

প্রসঙ্গত, ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া হলেও এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয় ৩ জুলাই। কিন্তু তার আগেই ৩০ জুন আপিল বিভাগের রায়ের ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ করে সংবিধান করা হয়।

সংসদে বিল পাশ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল পাশের ঠিক আগের দিন ২৯ জুন বিলের ওপর আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় এবং পরদিন ৩০ জুন বিলটি সংসদে পাশ হয়ে যায়।

বিল পাশের পরে এ বিষয়ে বক্তব্য দেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'আদালতের রায়ের আলোকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। তবে বিকল্প কোনো ফর্মুলা থাকলে সংসদে এসে বলুন। অযথা গণ্ডগোল করে জনগণকে কষ্ট দেবেন না। জনগণ আপনাদের ভোট দেয়নি। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার অর্থ হয় না। ভাগ্যে থাকলে আবার হয়তো ক্ষমতায় আসতে পারবেন।'

তিনি বিরোধী দলের উদ্দেশে সূরা আল ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, 'ভাগ্যে থাকলে আপনারা ক্ষমতায় আসতে পারবেন। ভাগ্যে না থাকলে পারবে না।' তিনি বিরোধী দলকে এই আয়াতটি ভালোভাবে পড়ার আহ্বান জানান।

নোট: তথ্যগুলো লেখকের 'সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক' (ঐতিহ্য/২০১১) বই থেকে গৃহীত।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

2024-09-09